বাংলাদেশের কর ব্যবস্থা: সরাসরি ও পরোক্ষ করের ভূমিকা

  1. Home
  2. »
  3. Uncategorized (শ্রেণী বহির্ভূত)
  4. »
  5. বাংলাদেশের কর ব্যবস্থা: সরাসরি ও পরোক্ষ করের ভূমিকা
বাংলাদেশের কর ব্যবস্থা: সরাসরি ও পরোক্ষ করের ভূমিকা

একটি দেশের জীবনীশক্তি প্রবাহমান রাখতে হলে প্রয়োজন হয় রাজস্ব আয়। আর এই রাজস্ব আয়ের অন্যতম মাধ্যম কর সংগ্রহ। কর ব্যবস্থা একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা, সামাজিক সেবা প্রদান এবং বাজেট ঘাটতি মোকাবেলার জন্য একটি কর ব্যবস্থার বিকল্প নেই। 

কর আদায়ের মাধ্যমে সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য অবকাঠামো এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সেবার ব্যয় পরিচালনা করে। বাংলাদেশে কর আয়ের ভিত্তি দুইটি : সরাসরি কর এবং পরোক্ষ কর।  এই নিবন্ধে বাংলাদেশের কর ব্যবস্থার বিবরণ এবং সরাসরি এবং পরোক্ষ করের ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

বাংলাদেশের কর ব্যবস্থার সাধারণ পটভূমি

বাংলাদেশের কর ব্যবস্থা মূলত দুটি স্তরের মাধ্যমে পরিচালিত হয় : কেন্দ্রীয় সরকার এবং স্থানীয় সরকার। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর উপর নীতি নির্ধারণ ও রাজস্ব সংগ্রহের প্রধান দায়িত্ব ন্যস্ত।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড প্রধান কর বিভাগের মাধ্যমে কর সংগ্রহ করে সেগুলো হলো : আয়কর, মূসক বা মূল্য সংযোজন কর কিছু, শুল্ক এবং সম্পূরক শুল্ক বিভাগ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সরাসরি ও পরোক্ষ করের মাধ্যমে সারা দেশ থেকে ৯৫ বেশি করে।

কর সংগ্রহের প্রধান মাধ্যম  হলো মূসক, আয়কর,  কাস্টমস ডিউটি ও সম্পূরক শুল্ক।  বাকি কর সংগ্রহ করা হয় অন্যান্য মাধ্যম থেকে যেমন যানবাহনের কর, জমির কর, বিভিন্ন টোল ফি ইত্যাদি।

সরাসরি কর

সরাসরি কর বা প্রত্যক্ষ কর হল রাজস্ব আয়ের অন্যতম  উৎস যেখানে কোন ব্যক্তির আয়ের উপর সরাসরি কর আরোপিত হয়। আয়কর এবং কর্পোরেট কর প্রত্যক্ষ করের প্রধান মাধ্যম।  ১৯৮৪ সালে চালু হওয়া আয়কর অধ্যাদেশের (Income Tax Ordinance)  এর মাধ্যমে আয়কর ব্যবস্থা পরিচালিত হয়।

সরাসরি করের মধ্যে আয়কর, জমি উন্নয়ন কর, উপহার কর,  নিবন্ধন ফি ইত্যাদি  অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশে আয়কর সাধারণত কোন ব্যক্তি, কোম্পানি, অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠান অথবা অন্যান্য ব্যক্তিদের উপর আরোপ করা হয়।

বাংলাদেশে ব্যক্তিগত আয় করার হার ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য নিম্নরূপ :

  • ৩,৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত আয়কর মুক্ত (০% করহার)
  • ৩,৫০,০০১ টাকা থেকে  ৪,৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত আয়ের ক্ষেত্রে কর হার ৫ %
  • ৪,৫০,০০১ টাকা থেকে ৭,৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত আর উপর করহার ১০%
  • ৭,৫০,০০১ টাকা পর্যন্ত ১১,৫০,০০০ টাকা আয়ের উপর ১৫% কর
  • ১১,৫০,০০১ টাকা থেকে ১৬,৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত আয়ের উপর কর হার ২০%।
  • ১৬,৫০,০০১ টাকার উপরে আয়ের জন্য করহার ২০% ।
  • অন্যদিকে অনাবাসীদের জন্য করহার সমস্ত আয়ের উপর নির্ধারিত ৩০%।

কর্পোরেট করার ক্ষেত্রে শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো ২০-২২.৫% কর প্রদান করে এবং ব্যক্তিগত কোম্পানির কর হার ২৭.৫% ।

যদিও সরাসরি কর রাজস্ব আয়ের অন্যতম অংশ বাংলাদেশে এখনো আয়কর প্রদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা তুলনামূলক কম।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী সরাসরি কর প্রায় ৩১ থেকে ৩৩ শতাংশ রাজস্ব আয়ের উৎস হিসেবে কাজ করে যার বড় অংশই হচ্ছে আয়কর এবং কর্পোরেট কর। এখন পর্যন্ত সরাসরি কর প্রদানের যোগ্য ব্যক্তিদের অনেকেই আয়কর প্রদানে আগ্রহী নন।

বাংলাদেশে কর ফাঁকি একটি  বৃহৎ সমস্যা হিসেবে দন্ডীয়মান।  আয়কর প্রদানের হার বৃদ্ধি করা এবং আয়কর প্রদানে যোগ্য করদাতাদের সংখ্যা বাড়ানো বর্তমানে একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ।

পরোক্ষ কর

পরোক্ষ কর সরাসরি আয়ের উপর ধরা হয় না বরং পণ্য ও সেবা ক্রয়ের সময় আরোপিত হয়। মূল্য সংযোজন কর (মূসক), সম্পূরক কর, শুল্ক, বৈদ্যুতিক শুল্ক, বিজ্ঞাপন কর ইত্যাদি পরোক্ষ করের অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের সিংহভাগ রাজস্ব আয়ের উৎস হলো পরোক্ষ কর।  রাজস্ব আয়ের প্রায় ৭২ শতাংশ আসে পরোক্ষ করের মাধ্যমে। 

বাংলাদেশের প্রধান পরোক্ষ কর হচ্ছে মূল্য সংযোজন কর বা মূসক।  বাংলাদেশ ১৯৯১ সালে ভ্যাট আইনের মাধ্যমে এই কর প্রবর্তিত হয় এবং এটি পণ্য বা সেবা বিক্রয়ের বিভিন্ন স্তরে আরোপিত হয়। মূল্য সংযোজন করের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন পর্যায়ে এই কর আদায় করে।

বাংলাদেশের ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ এবং এটি উৎপাদন,  ব্যবসা ও আমদানি পর্যায়ে আরোপিত হয়।  পরোক্ষ করের অন্যতম সুবিধা হল এটি সহজেই সংগ্রহ করা যায় এবং এটি খুব দ্রুত সময়ে রাজস্ব প্রদান করে।

মূল্য সংযোজন করের একটি নেতিবাচক দিক হচ্ছে এই কর অতি দরিদ্র জনগণের উপর কর আদায়ের জন্য অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।  পরোক্ষ করের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রত্যেক জনগণের কাছ থেকে একই হারে  কর আদায় করা হয় এক্ষেত্রে করদাতার আয়ের অবস্থা বিবেচনা করা হয় না যা অনেক ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ হিসেবে দেখা হয়।

পরোক্ষ করের মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষের উপর অতিরিক্ত বোঝা সৃষ্টি হয়  কারণ বাংলাদেশ পরোক্ষ করের উপর অধিকাংশে নির্ভরশীল ।

কর সংগ্রহের প্রতিবন্ধকতা

বাংলাদেশে কর সংগ্রহের হার অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় অনেক কম।  মোট রাজস্ব আয়ে কর, বিশেষ করে সরাসরি করের ভূমিকা কম হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো কর দাতাদের কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা।

 কর ফাঁকির প্রবনতা বৃদ্ধি ও কর প্রদানকারীর স্বল্প সংখ্যার কারণে প্রতিবছর দেশে রাজস্ব খাতে বিরাট ক্ষতি হয়। ধনী ব্যক্তিরা এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়শই কর ফাঁকি দিয়ে থাকে।   অনেক ক্ষেত্রে কর প্রশাসনের দুর্বলতার কারণে বড় ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠান সুযোগ পাচ্ছে ফলশ্রুতিতে সাধারণ মানুষের উপর করের বোঝা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পরোক্ষ করের উপর নির্ভরশীলতা

বাংলাদেশের কর ব্যবস্থা মূলত পরোক্ষ করের উপর নির্ভরশীল। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের মোট রাজস্ব আয়ের প্রায় ৬৭ থেকে ৬৮% পরোক্ষ কর, যার বেশিরভাগ আদায় হয়েছে মূল্য সংযোজন করের মাধ্যমে।

এছাড়া পরোক্ষ করের অন্যান্য উৎস – শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক এবং বিভিন্ন ধরনের শুল্কের উপর ও রাজস্ব আয় অতিমাত্রায় নির্ভরশীল যা এক শ্রেনীর করদাতাদের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে।  সরাসরি করের অতি নগণ্য ভূমিকা দেশের জন্য ক্ষতিকর কারণ পরোক্ষ  করের উপর নির্ভরশীলতা কোন সমতামূলক কর ব্যবস্থা নয়।

বর্তমান কর ব্যবস্থার উন্নয়নের আবশ্যকতা

বাংলাদেশের কর ব্যবস্থাকে আরও দক্ষ এবং কার্যকরী করে তুলতে হবে যাতে করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের জনগণের উপর থেকে করের চাপ বিলুপ্ত করা যায়। কর ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য প্রথমত কর ফাঁকি রোধ করতে হবে, এবং এটির জন্য প্রশাসনের দক্ষতা বাড়ানো জরুরী।

অন্যদিকে আয়কর প্রদানকারীর সংখ্যা বাড়ানোর জন্য কর নীতির সংস্কার করতে হবে এবং কর প্রদানের প্রক্রিয়াটি সহজ এবং স্বচ্ছ করতে হবে। কর গ্রহণের প্রক্রিয়াটি ডিজিটালাইজড করা অত্যন্ত জরুরী যার মাধ্যমে কর প্রদানের প্রক্রিয়াটি হয়ে যায় ঝঞ্ঝাট মুক্ত এবং সময় সাশ্রয়ী।

তাছাড়া করদাতাদের মধ্যে কর প্রদানের প্রণোদনা সৃষ্টি করার জন্য কর নীতির উন্নয়নের প্রয়োজন যাতে করে কর প্রদান ব্যবস্থাকে আকর্ষণীয় করে তোলা যায়৷

কর প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং কর আদায় প্রক্রিয়ার প্রযুক্তিগত উন্নতি সাধন করতে হবে। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সাধনের মাধ্যমে কর আদায়ের প্রক্রিয়াটি আরো স্বচ্ছ করা যাবে যার ফলে নির্দিষ্টসংখ্যক কর দাতাদের সংখ্যা পর্যবেক্ষণ করা যাবে। এর মাধ্যমে কর ফাঁকির পরিমাণও হ্রাস করা সম্ভব হবে ।

Also, Readঅনলাইনে আয়কর জমা দেওয়ার সহজ উপায়

পরিসমাপ্তি

কর বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম ভিত্তি। কিন্তু বর্তমানের কর কাঠামো উন্নয়নের অনুকূলে নেই। বর্তমান কর ব্যবস্থা সমাজে একটি গভীর বৈষম্য তৈরি করেছে যা খুব দ্রুত প্রতিহত করতে হবে। 

দেশের উন্নয়নের জন্য কর প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধি, কর ফাকিঁ রোধ এবং কর প্রদানের জন্য জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য।

বাংলাদেশের কর ব্যবস্থা কে আরও শক্তিশালী, কার্যকর এবং সমতামূলক করার জন্য কর নীতির সংস্কার করা অনিবার্য। কর ব্যবস্থার উন্নয়ন বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও সুসংহত করতে এবং অর্থনৈতিক গতিকে উন্নীত করতে পারবে।

Table of Contents

মন্তব্য করুন